ক্যানসারের লক্ষণ নিয়ে অবহেলা নয়

ফানাম নিউজ
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:২৯

ব্যস্ততার কারণে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা আমাদের যেন ক্রমেই বাড়ছে। অন্যান্য রোগের পাশাপাশি ক্যান্সারের মতো জটিল রোও বেড়ে চলছে। এক সময় দেখা যেত, বয়স বাড়লে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে, কিন্তু এখন যে কোনো বয়সে নানা জটিল রোগে আক্রান্তের ঘটনা ঘটছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। সবাই যদি নিজেদের সচেতন রাখি, ক্যান্সারের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানি, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তে উৎসাহিত হই, সঠিক সময়ে যথাযথ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নেই, তাহলেই এর ভয়াবহতা অনেকাংশে কমবে।

শরীরের যে কোনো ক্ষত না শুকালে, অস্বাভাবিক রক্তপাত হলে, মূত্র বা মল ত্যাগের অস্বাভাবিকতা, স্তনের গঠনের পরিবর্তন, গিলতে অসুবিধা, ক্রমান্বয়ে ওজন হ্রাস ও ক্ষুধামন্দা, গলায় কর্কশ শব্দ, কাশি, অকারণ ক্লান্তি, প্রায়ই জ্বর জ্বর অনুভূতি ইত্যাদি সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত রোগের কারণ নিশ্চিত হতে হবে। 

বিস্তারিত লিখেছেন ডা. মো. ফারুক হোসেন

ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণের মধ্যে একটি হচ্ছে ওজন কমে যাওয়া। হঠাৎ করে যদি ওজন অনেক কমে যায়, তাহলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা একবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ক্যানসার সেল শরীরের স্বাভাবিক শক্তি ব্যবহার করে থাকে, যার কারণে ওজন কমতে পারে। ক্যানসার ছাড়াও ওভার এক্টিভ থাইরয়েড গ্লাণ্ডের কারণে ওজন কমে যেতে যারে। তাই হঠাৎ করে ওজন কমে গেলে ক্যানসার ভেবে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে আপনাকে সচেতন হতে হবে।

মেয়েদের মাসিকের সময় ব্লোটিং বা পেট ফাঁপা অথবা ফুলে যাওয়াও ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের লক্ষণ। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। সিটি স্ক্যান এবং রক্ত পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য।

নারীদের ক্ষেত্রে প্রদাহজনিত ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ হিসাবে ব্রেস্টের ওপরে ত্বক লাল এবং পুরু হয়ে যাওয়া দেখা যেতে পারে। পিরিয়ডের সময় অনেক সময় ব্রেস্টে লাম্প বা চাকা দেখা দেয় আবার চলেও যায়। নতুন কোনো লাম্প বা চাকা যদি এক মাস সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও চলে যাচ্ছে না বরং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাহলে দেরি না করে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। এছাড়াও পিরিয়ডের আগে অন্তর্বাসে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের সমস্যা অর্থাৎ স্পটিংয়ের ক্ষেত্রে এন্ড্রোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। পরিপাক নালি থেকে রক্তক্ষরণ কলোরেক্টাল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

শরীরে তিল বা আঁচিল যদি অনিয়মিত আকৃতি বা রঙে পরিবর্তিত হয় অথবা দুই পাশের ত্বক একই ধরনের না হয়, তাহলে ত্বকের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে ধরে নিতে হবে। এগুলো ছাড়াও ত্বকের অন্যান্য পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। ত্বকের পিগমেন্টেশন বা স্বাভাবিক রঙের পরিবর্তন, রক্তপাত, অতিরিক্ত স্কেলিং অর্থাৎ এপিডারমিস বা বাইরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত অথবা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মিলানোমা ত্বকের একটি ক্যানসার যা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

গিলতে অসুবিধা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল নালির ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে; যেমন ইসোফেজিয়াল ক্যানসার। ক্রমাগত গিলতে অসুবিধা হলে দ্রুত আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া মূলত পাইলসের লক্ষণ। এটি কোলন ক্যান্সারেরও একটি লক্ষণ হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার ডাক্তার কোলোনোস্কোপি করতে দিতে পারেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত দেখা গেলে মাসিকের রক্তের কারণেও হতে পারে, যা অনেক সময় বোঝা যায় না। কিন্তু এটি ব্লাডার অথবা কিডনির ক্যান্সারের কারণে হতে পারে। তাই এসব বিষয়ে ন্যূনতম সচেতন হতে হবে।

কাশির সঙ্গে রক্ত ব্রংকাইটিস, যক্ষ্মা, এমনকি ভাগ্য খারাপ হলে ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে হতে পারে।

যখন ডিপ্রেশন বা হতাশার সঙ্গে এবডোমিনাল পেইন পেট ব্যথা যুক্ত হয়, তখন এটি প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

যখন বদহজম শনাক্তযোগ্য কারণ ছাড়া দেখা যায়, যেমন ফ্যাটি খাবার, গর্ভাবস্থা তখন অবশ্যই বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। বর্ণনাতীত এবং অনবরত বদহজম খাদ্যনালি, পাকস্থলী অথবা গলার ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে।

মুখের অভ্যন্তরে সাদা প্যাঁচ বা দাগের মতো দেখা গেলে অথবা জিহ্বার ওপর সাদা স্পট দেখা দিলে তা লিউকোপ্লাকিয়ার মতো ক্যানসারপূর্ব অবস্থার লক্ষণ হতে পারে আবার অন্য কারণেও হতে পারে। লিউকোপ্লাকিয়া থেকে ওরাল ক্যানসার হতে পারে।

বর্ণনাতীত ব্যথা ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে। অধিকাংশ সময় এক্ষেত্রে ক্যানসার হয় না। কিন্তু ব্যথা যদি অনবরত চলতেই থাকে আর ব্যথার জানা কোনো কারণ না থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন কেন ব্যথা হচ্ছে।

লসিকা গ্রন্থি বা লিম্ফনোড বড় হয়ে যাওয়া অথবা বগলের নিচে লিম্ফনোডে লাম্প বা চাকা ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে। এটি সংক্রমণের কারণে হতে পারে আবার ক্যান্সারের কারণেও হতে পারে।

ঠান্ডাজনিত জ্বর অথবা ভাইরাসের কারণে জ্বর ছাড়াও জ্বর যখন ব্যাখ্যাতীত তখন তা ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে। কিছু ব্লাড ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ যেমন লিউকেমিয়া এবং লিম্ফোমার কারণে জ্বর আসতে পারে। যখন একটি ক্যানসার উৎপত্তি স্থল থেকে শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা ডাক্তারি ভাষায় মেটাসটেসিস নামে পরিচিত সেক্ষেত্রেও জ্বর আসতে পারে। আপনার যদি ব্যাখ্যাতীত জ্বর থাকে তাহলে বুকের এক্সরে, সিটি স্ক্যান অথবা এমআরআই প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষাও প্রয়োজন।

ক্লান্তি অনেক অসুখের লক্ষণ হিসাবে দেখা দিতে পারে। কিন্তু অনেক সময় ক্লান্তি কিছু ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে, যেমন লিউকেমিয়া অথবা কিছু কোলন এবং পাকস্থলীর ক্যানসার।

যদি আপনার ঠান্ডা, অ্যালার্জি বা ফ্লু না থাকে, কিন্তু লম্বা সময় ধরে কাশি থাকে এবং সেটি তিন থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়, এ ক্ষেত্রে ফুসফুস এবং শ্বাসনালির রোগসহ ক্যানসারও হতে পারে।

উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। লক্ষণগুলো সবক্ষেত্রে ক্যানসার না হলেও কোনো না কোনো সিস্টেমিক রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। তাই লক্ষণের শুরুতেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া খুবই জরুরী। মনে রাখবেন, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার ধরা পড়লে রোগীকে শতভাগ সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

লেখক : দন্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, ইমপ্রেস ওরাল কেয়ার, বর্ণমালা, সড়ক, ইব্রাহিমপুর, ঢাকা।