অথৈ সাগরে মুরসালিনের পরিবার

ফানাম নিউজ
  ২২ এপ্রিল ২০২২, ০৮:০৮

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুর স্কুল গলি লোকে লোকারণ্য। প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে একটি ঘর থেকে। এরই মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্সে মুরসালিনের (২৪) লাশ পৌঁছে ওই গলিতে।

অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই মা বুকফাটা কান্নায় ছেলের লাশের ওপর আছড়ে পড়েন। স্ত্রী বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছেন। তারা বলছেন, আল্লাহ এ তুমি কী করলে। আমরা এখন কাকে নিয়ে বাঁচব।

এই পরিবারটি কে দেখবে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে গুরুতর আহত মুরসালিন বৃহস্পতিবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে মারা যান। নিউ সুপার মার্কেটের একটি রেডিমেড কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসাবে চাকরি করতেন তিনি। 

দুপুরে মুরসালিনের লাশ আসবে এমন খবরে গোটা এলাকার সর্বস্তরের মানুষ স্কুল গলিতে এসে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় মহিলারা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছিলেন।

প্রতিবেশী মনোয়ার বেগম বলেন, ‘এমন ভালো মানুষটাকে কারা পিটিয়ে হত্যা করল। এর বিচার না হলে দেশে আল্লাহর গজব পড়বে। লাশ দেখতে আসা লোকজনের ভিড়ে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।’ 

স্কুল গলির ছোট্ট একটি রুম ভাড়া নিয়ে স্ত্রী, কন্যা ও ছেলে নিয়ে বাস করতেন মুরসালিন। প্রতি মাসে ভাড়া দিতেন চার হাজার টাকা। ওই রুম থেকে আর্তনাত ছড়িয়ে পড়ছিল অলিগলিতে।

মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদছিলেন মেয়ে হুমায়রা সুমাইয়া (৭), ছেলে হামিম (৪)। অসুস্থ হুমায়রার মাথায় পানি দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। পেটে হাত রেখে চিৎকার করছিল ছোট্ট এ কন্যাশিশু। সম্প্রতি তার পেটে অপারেশন (অ্যাপেন্ডিসাইটিস) হয়েছে। 

মুরসালিনের স্ত্রী মিতু আক্তার বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, আমার স্বামী নিরীহ মানুষ। সকালে দোকানে যেতেন, আসতেন রাতে। দুই সন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল। মেয়েকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন। মেয়ের অপারেশন হওয়ার পর থেকে রাতে মেয়েকে জড়িয়ে ঘুমাতেন। বলতেন, মেয়েকে ফেলে দোকানে যেতে ইচ্ছে করে না। 

মিতু বলেন, সংঘর্ষের দিন সকালে যখন সে (মুরসালিন) রুম থেকে বের হচ্ছিল, ছেলে তখন তার গলা ধরে বারবার বলছিল-বাবা আজ দোকানে না গেলে হয় না। মেয়ে বলে, বাবা তুমি দোকানে না গিয়ে আমাদের কাছে বসে থাকো। তখন সন্তানদের সান্ত্বনা দিয়ে সে (মুরসালিন) বলে, ‘ঈদের বাজার, দোকানে না গেলে বোনাস, বেতন পাওয়া যাবে না।’ 

ঋণ করে মেয়ের অপারেশন করা হয়েছে জানিয়ে স্ত্রী মিতু বলেন, ‘দোকান থেকে মাসে ৯ হাজার টাকা বেতন পেতেন আমার স্বামী। বোনাস-বেতন পেয়ে ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল। ছেলে-মেয়েকে ঈদে ভালো কিছু কিনে দিতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের ধরে বিচার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানাই। স্বামী হত্যার ক্ষতিপূরণ যেন পাই সেই ব্যবস্থা আপনি করবেন।’ 

সরেজমিন দেখা যায়, মুরসালিনের লাশ দেখতে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী নেতা কিংবা দোকান মালিক কেউ আসেনি। লাশের পাশে দাঁড়িয়ে স্বজন আরিফুল ইসলাম জানান, সংঘর্ষের মধ্যে মালিক দোকান খোলা না রাখলে মুরসালিন সেখানে যেত না।

সংঘর্ষে কিন্তু দোকান মালিক কিংবা কোনো শিক্ষার্থী মারা যায়নি। মারা গেল একজন সাধারণ কর্মচারী। এর ক্ষতিপূরণ সরকার, দোকান মালিকদের দিতে হবে। পরিবারটির দায়িত্ব খোদ প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। 

মিজানুর রহমান নামে এক স্কুলশিক্ষক বলেন, রাত-দিনজুড়ে সংঘর্ষ হলো, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থামাতে পারলেন না। তাদের ব্যর্থতায় একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ গেল। তাই এর দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এত উন্নয়নে কী লাভ, যদি মানুষের জীবনই নিরাপদ না হয়! 

ছেলের শোকে বারবার মূর্ছা যাওয়া নূরজাহান বলেন, স্বামী মারা গেছেন আট বছর আগে। দুই ছেলেই আমার ভরসা। মুরসালিন ছোট। বড় ছেলে নূর মোহাম্মদও একটি দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে। ওরাই আমার ভরসা।

সামান্য বেতন পেত। তাই আমার হাতে তুলে দিত। তিনি বলেন, ‘এটা কেমন দেশ যে, প্রকাশ্যে এভাবে মানুষ হত্যা করা হয়। ইট দিয়ে আমার ছেলের মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। পেটানো হয়েছে। মামলা করলে কী হবে! ছেলে হত্যার বিচার কি পাব? গরিব মানুষ বিচার পায় না। আল্লাহ, ওদের বিচার করবে। তবে আমার ছেলের ক্ষতিপূরণ সরকারকে দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ না দিলে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখব।’ 

মুরসালিনের দুই সন্তানের মাথায় হাত রেখে স্থানীয় এক মুরব্বি বলেন, এখন হয়তো মার্কেট খুলবে। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করবে। কিন্তু মুরসালিনের সন্তান দুটির কী হবে? বিচার কি হবে, ক্ষতি পূরণ কি ওরা পাবে?

রাজনৈতিক কর্মী কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের মৃত্যু এভাবে হলে, স্ত্রী-ছেলে মেয়েদের চাকরি প্রদানসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু দরিদ্র মুরসালিনের স্ত্রীর জন্য কেউ কি চাকরি বা আর্থিক সুবিধা প্রদানে এগিয়ে আসবেন? 

বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই মুরসালিনের লাশের পাশে ছিলেন বড় ভাই নূর মোহাম্মদ। হাসপাতাল থেকে মর্গ পর্যন্ত দৌড়ান তিনি। নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এ দেশে গরিবরা বিচার পায় না। কেউ বিচারও করবে না।’

বিকালে স্থানীয় স্কুল মাঠে জানাজা শেষে সন্ধ্যায় মুরসালিনকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। কবরস্থানেও স্থানীয় লোকজন ছুটে যান। 

নিউমার্কেটের ঘটনায় মুরসালিনের আগে নাহিদ হোসেন (২০) নামে এক পথচারী মারা যান। ওই তরুণ ডি-লিংক নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ‘ডেলিভারিম্যান’ হিসাবে কাজ করতেন।

নাহিদ হোসেনও তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচর রসুলপুর এলাকায় ভাড়া থাকতেন। অর্থাৎ নিউমার্কেটে সংঘর্ষে নিহত দুজনই রসুলপুর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তাদের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

সূত্র: যুগান্তর