ই-কমার্স জালিয়াতি রোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন

ফানাম নিউজ
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৫৯

সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হুশিয়ারি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান কোনো কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না মাল্টিপারপাস ও ই-কমার্সের নামে প্রতারণা। মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ পাস করেও প্রতারণামূলক এ বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তাই অনলাইন প্ল্যাটফরমে পণ্য বা সেবা বিক্রির নামে এসব কোম্পানির অভিনব প্রতারণা ও জালিয়াতি রোধে এবার কঠোর হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।  সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর একযোগে কাজ করবে। তবে সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও গ্রাহক সচেতনতার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ বিষয়ে গতকাল বলেন, ই-কমার্স জালিয়াতি বন্ধে ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। এমএলএম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা একেবারেই নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-কমার্স, ই-বিজনেস ও ডিরেক্ট টেলিমার্কেটিং, ক্যাশলেস সোসাইটি প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ‘এমএলএম কোম্পানি’ গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন এনে এ ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি রোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি যদি মনে করে আইন সংশোধন করতে হবে তা হলে তা-ই করা হবে। পাশাপাশি ই-কমার্সের নীতিমালায়ও পরিবর্তন আনা হবে।

এমএলএম ব্যবসার নামে এ প্রতারণা অন্তত দুই দশক ধরে চললেও যুবক ও ডেসটিনির কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আগে এ নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য হয়নি। প্রথমে যুবক ও পরে ডেসটিনির প্রতারণা গোমর ফাঁস হলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ডেসটিনি, যুবক কিংবা অন্যান্য এমএলএম প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রতারিত লাখ লাখ মানুষ অর্থ ফেরত পায়নি। ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণিত মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পাশাপাশি পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়ে ছিল। তার পরও এত কোম্পানি কীভাবে অবৈধ এমএলএম ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে এবার অভিযানে নামবে মন্ত্রণালয়।

গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানিগুলো সেবা ও পণ্য দিচ্ছে না। ফলে বছর না ঘুরতেই লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। সম্পতি ই-ভ্যালির বিরুদ্ধেও একই ধরনের জালিয়াতি ধরা পড়ে। এ অভিযোগে বৃহস্পতিবার দুই কর্ণধারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

এসব কোম্পানির প্রতারণায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। কর্তৃপক্ষ অবাক করা তথ্য দিয়ে বলেছে, এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজে নিয়োজিত কোনো একটি কোম্পানির হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা দুদক কর্তৃক অবৈধ করা হলেই তারা অন্য নামে ভিন্ন এলাকায় আবার কার্যক্রম শুরু করে। অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে, টাকা একবার বেহাত হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা সহজ নয়। অতএব, জনগণের অজ্ঞতা ও সরলতাকে পুঁজি করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন তাদের কষ্টার্জিত টাকা আত্মসাৎ করতে না পারে, সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, সমবার অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করছে। তার পরও মানুষ সেখানে অর্থলগ্নি করছে। অতীতেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে টাকা বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর পরও মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসেনি। তিনি বলেন, সচেতনতার বিকল্প কিছু নেই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা রোধে প্রয়োজনে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট, দুদক, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করবে। সংস্থাগুলো বিভিন্ন অভিযান ও তদন্তপ্রাপ্ত অপরাধের তথ্য নিজ নিজ আইনের আওতায় অভিযান পরিচালনা করবে।

সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে সংস্থাগুলোর তরফ থেকে এ সংক্রান্ত তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সংস্থাগুলো বিভিন্ন অভিযান ও তদন্তে প্রাপ্ত অপরাধের তথ্য নিজ নিজ আইনের আওতায় না পড়লে অন্য সংস্থাকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করবে। তবে এ ব্যাপারে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করা হবে।

নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মূল্য সংযোজন কর ঢাকার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘অনলাইন কেনাকাটায় ভ্যাট ফাঁকিসহ নানা আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমরা ভ্যাট আইনে বেশকিছু মামলা করেছি। ই-অরেঞ্জ, আলেশা মার্ট, পেপারফ্লাই, ইভ্যালিসহ অনলাইন প্ল্যাটফরমে পণ্য বিক্রয়কারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করা হয়েছে। আরও যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান শুল্ক ও মূল্যসংযোজন কর ফাঁকি দিয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। এসব প্রতিষ্ঠানে অভিযানের সময় দেখা যায় অর্থ পাচারসহ কিছু অপরাধ এমন আছে যা আমাদের আইনের আওতায় পড়ে না; এসব অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি। পাশাপাশি তারাও আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক ও ‘ই-বাণিজ্য করব নিজের ব্যবসা গড়ব’ প্রকল্প পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ নানামুখী জালিয়াতি রোধে সরকারের বেশ কয়েকটি দপ্তর কাজ করছে। এদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। এ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ইভ্যালিসহ ১০ কোম্পানি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ভোক্তা অধিকার আইন ও দণ্ডবিধি আইন লঙ্ঘন করেছে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আইন অমান্য করেছে। তাদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দপ্তর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। তবে মানুষের সচেতনতার বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে একটি সমস্যা গ্রাহকের তরফ থেকে অভিযোগ আসে না। ফলে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এর আগে বড় বড় অনিয়ম হলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসেনি।

বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী মহলেও উদ্বেগ রয়েছে। এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি একে আজাদ বলেন, ই-কমার্সের নামে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ লুটপাটের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে ই-কমার্সের ব্যাপক প্রসার হলেও আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি ও পরিবীক্ষণ না থাকায় এ খাতে জবাবদিহিতা গড়ে ওঠেনি। কিছু সংখ্যক মুনাফালোভী প্রতারক গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে টাকা লুট করছে। যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ লুট করেছে তাদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে প্রতারিত হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা নিতে হবে।