বরিশাল মহাশ্মশানে ৩৫ বছর সমাধিসৌধ বানান যে মুসলিম কারিগর

ফানাম নিউজ
  ২২ নভেম্বর ২০২১, ২১:১০

প্রিয়জনের স্মৃতি রক্ষায় সমাধিসৌধ তৈরি করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ইট-পাথরের এই সৌধ কেবল মৃতদের পরিচিতি বহন করে না, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পরিবারের সদস্যদের আবেগ ও ভালোবাসা। স্বজনদের জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই স্মৃতিচিহ্নকে সুনিপুণ দক্ষতায় সৌধের আকৃতি দেন মুসলিম রাজমিস্ত্রী তাহের আলী খান।

দেশের সবচেয়ে বড় শ্মশান হিসেবে পরিচিত বরিশাল মহাশ্মশান। গত ৩৫ বছর ধরে এই শ্মশানঘাটে ১০ হাজারের বেশি সমাধি তৈরি করেছেন তাহের আলী। তবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ সব ধরনের ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার পরেও কট্টরপন্থীদের সমালোচনার হাত থেকে রেহাই মেলেনি তার।

মুসলিম হয়েও হিন্দুদের সমাধি বানানোর বিষয়ে ৬০ বছর বয়সী এ রাজমিস্ত্রী বার্তাসংস্থা এএফপি’কে বলেন, আমার রাসুল আমাকে সৎ পথে রুটিরুজি জোগাড় করতে বলেছেন। তিনি আমাদের চুরি, কাউকে আঘাত দেওয়া অথবা যেকোনো অপরাধ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।

তিনি বলেন, আমি এখানে স্মৃতিস্তম্ভ বানাই। এই কাজে এমন কিছু দেখি না, যা আমার ধর্মকে সংকটে ফেলবে।

১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে প্রায় ১০ শতাংশই সনাতন ধর্মাবলম্বী। এ দেশে রাজনীতি, বাণিজ্য, সরকারি চাকরি- সবখানেই রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সরব উপস্থিতি।


তবে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে এ অঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের মুখেও অনেকে দেশ ছাড়েন। বাংলাদেশে এখনো নানা উসকানিতে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। গত মাসে দুর্গাপূজার সময় পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে দেশব্যাপী উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে প্রাণ হারান অন্তত ছয়জন।

এ ধরনের ঘটনা খুব কষ্ট দেয় রাজমিস্ত্রী তাহের আলীকে। সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময় নিয়মিত হিন্দু বন্ধুদের খোঁজখবর রেখেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তাহের আলী বলেন, হিন্দুদের আমি ভাইবোনের মতো দেখি। কাজের জন্য তারা আমাকে ভালোবাসা দিয়েছেন। আমি মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে সমাধিসৌধ বানাই। কারণ হারানো প্রিয়জনের জন্য সবাই বিশেষ কিছু চায়।

কাজের জন্য দিনের অধিকাংশ সময় শ্মশানঘাটে কাটে তাহের আলী খানের। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় চিতা পোড়ানোর মাঠের পাশে চলে সমাধিসৌধ বানানোর কাজ। বরিশাল মহাশ্মশানের আশপাশের বেশিরভাগ সৌধই তার হাতে তৈরি।

সাধারণ সমাধিসৌধগুলো আকারে ছোট হয়। কনক্রিটের বেদির ওপর নির্মিত সৌধগুলো পশ্চিমা সমাধি স্মারকের মতোই। সেগুলোর নিচে সাধারণত মৃতব্যক্তির চিতার ভস্ম সমাহিত করা হয়।

সবচেয়ে বড় সৌধগুলো কয়েক স্তর বিশিষ্ট হয়, যার ওপর পিরামিড আকারের রঙিন মিনার থাকে। এ ধরনের একেকটি সৌধের দাম হতে পারে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত।

তাহের আলী বলেন, মৃতদের জন্য একটি সুন্দর সৌধ বানাতে পারলে অনেক শান্তি পাই। আমার মনে হয়, শোকাহত পরিবারের জন্য এমন কিছু করতে পেরেছি যাতে তারা প্রশান্তি লাভ করতে পারেন।

সমাধিসৌধ বানানোর কাজে বরিশালের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বেশ জনপ্রিয় তাহের আলী। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ তার কাছে বায়না নিয়ে ছুটে আসেন। তিনি যে মুসলিম, এটি কোনো বিষয়ই নয় তাদের কাছে।

মায়ের জন্য সমাধিসৌধ বানাতে তাহের আলীর কাছে আসা গৌরাঙ্গ দাশ বলেন, তিনি মুসলিম কি না, তাতে কিছু যায় আসে না। তার কাজ চমৎকার। উনি আমার ঠাকুরদার সমাধি বানিয়েছিলেন। সেটি দারুণ ছিল।

প্রতিবছর ভূত চতুর্দশী উৎসবের সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রিয়জনদের স্মরণে সমাধিসৌধগুলোতে প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালিয়ে থাকেন। সেসময় অসংখ্য স্মরণসভায় আমন্ত্রণ পান তাহের আলী।

জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বরিশাল মহাশ্মশানে কাটিয়ে দেওয়া তাহের আলীকে শ্মশানঘাটের সত্ত্বাধিকারীরাও পরিবারের সদস্যের মতো দেখেন। যদিও তিনি এখন পর্যন্ত ঐচ্ছিকভিত্তিতেই কাজ করে চলেছেন।

শ্মশানের সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার বলেন, সৃতিস্তম্ভ বানানোয় তাহের আলী সেরা বলেই মানুষ তার কাছে আসে। আমরা তাকে এবং তার কাজকে ভালোবাসি।

সূত্র: আল-জাজিরা