চীন কি বিশ্বে শান্তির দূত হতে যাচ্ছে?

ফানাম নিউজ
  ২২ মার্চ ২০২৩, ০৩:৫২

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর হলো। এখনো তুমুল লড়াই চলছে দেশ দুটির মাঝে। পশ্চিমাদের সরবরাহ করা অস্ত্রে তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছে কিয়েভও। এর মাঝেই তিন দিনের সফরে মস্কোতে অবস্থান করছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। শি জিনপিং কি তাহলে শান্তির বাণী নিয়ে হাজির হয়েছেন, এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়।

সোমবার (২০ মার্চ) ক্রেমলিন সফরের প্রথম দিনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে অগ্রাধিকার পেয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে চীনের শান্তি প্রস্তাব, বেইজিং-মস্কোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক। একই সঙ্গে এই সফরের উদ্দেশ্য একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে চীনের মর্যাদাকে আরও সমুন্নত করার অভিপ্রায় শি জিনপিংয়ের।

চলতি মাসের শুরুতে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক নতুন করে শুরু করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চীন। ৭ বছর যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর আবারও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সম্মত হয়েছে সৌদি আরব ও ইরান। চীনের মধ্যস্থতায় কয়েকদিনের আলোচনার পর অবশেষে দূতাবাস ফের চালু করতে রাজি হয় দুই দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান ও তেল সমৃদ্ধ দুই দেশের এই পুনর্মিলন বিশ্ব ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এমন মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাছাড়া বেইজিং বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় দেশগুলোতে কূটনৈতিক সম্পর্কে অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা করেছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক প্রভাবকে দূরে সরানোর সাহস দেখিয়েছে। অনেকের দাবি, চীন তাদের এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বেশ সফলতা পেয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, শি জিনপিং ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানের জন্য ১২-দফার শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য এ সফর করছেন। চীনের এ শান্তি প্রস্তাবকে সম্মানের সঙ্গে দেখছে মস্কোও।

ইউক্রেন-রাশিয়ার তীব্র লড়াই অব্যাহত থাকার মাঝেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবাকে ফোন করেছিলেন সম্প্রতি। ফোনালাপে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বেইজিং উদ্বিগ্ন বলে জানান তিনি। মস্কোর সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনার আহ্বানও জানান কিন গ্যাং।

বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) কিন গ্যাং ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবাকে টেলিফোনে আরও বলেছেন, চীন শান্তি আলোচনার অগ্রগতি দেখতে চায়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘চীন ইউক্রেন ইস্যুতে একটি উদ্দেশ্যমূলক ও ন্যায্য অবস্থানে থেকে সমর্থন করেছে।’ চীনের এ মন্ত্রী আরও বলেন, চীন ‘শান্তি প্রতিষ্ঠায় আলোচনার অগ্রগতির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ শান্তি আলোচনার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও আহ্বান জানান তিনি।

এর আগে শির শান্তি পরিকল্পনা কিয়েভ ও ওয়াশিংটনে একটি উষ্ণ প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। তবে, চীনা নেতার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি বলেও ধারণা করছেন কেউ কেউ। যা মস্কোর ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আরও গভীর হয়েছে।

চীনের অস্ট্রেলিয়ান সেন্টারের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো এডওয়ার্ড চ্যান আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘শির রাশিয়া সফর মূলত মহামারি পরবর্তী যুগে ঘনিষ্ঠ চীন-রাশিয়ান সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, যখন উভয় পরাশক্তি কঠিন সময়ের সম্মুখীন হচ্ছে।’

চ্যান আরও বলেছেন, ‘এটা আশা করা যায়, চীন ও রাশিয়া অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে একটি দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।’

শি ও পুতিন বৃহত্তর সহযোগিতার অংশ হিসেবে যে অর্থনৈতিক ইস্যুতে গুরুত্ব দিতে পারেন তা হলো জ্বালানি, চীনের পণ্য রপ্তানি, ডলারের বিকল্প ব্যবহার। পশ্চিমারা রুশ জ্বালানি নেওয়া বন্ধ করার পর দেশটি থেকে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল ও গ্যাস সস্তায় কিনেছে চীন। চীনের কাস্টমসের তথ্য বলছে, রাশিয়া জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে চীনের শীর্ষ তেল সরবরাহকারী ছিল। প্রতিদিন ১ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ব্যারেল রপ্তানি হতো যেখানে ২০২২ সালে ছিল ১ দশমিক ৫৭ ব্যারেল।

গত বছর চীনের রাশিয়ান পাইপলাইন গ্যাস ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের আমদানি যথাক্রমে ২ দশমিক ৬ গুণ এবং ২ দশমিক ৪ গুণ বেড়ে ৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন এবং ৬ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন হয়েছে। চীনের রাশিয়ান কয়লার আমদানি ২০ শতাংশ বেড়ে ৬৮ দশমিক ০৬ মিলিয়ন টন হয়েছে।

চীন ও রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘বন্ধুত্ব অসীম’ বলে জানান দেয়। রাশিয়া ইউক্রেন আগ্রাসনের কয়েক সপ্তাহ আগে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনে বেইজিং সফর করছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। উভয় দেশের শীর্ষ নেতারা তাদের বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে।

রাশিয়া যখন চীনের কাছে সস্তায় গ্যাস, তেল বিক্রি করছে তখন দেশটি চীন থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়েছে। চীনের কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চীন রাশিয়ায় ২০২২ সালে ৭৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর আগের বছর রপ্তানি করে ৬৭ দশমিক ৫৭ ডলার।

ইউক্রেন আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমারা লেনদেন বন্ধ করলে এবং নিষেধাজ্ঞার জেরে ডলারে লেনদেন করতে বিপাকে পড়ে যায় রাশিয়া। বিশ্বের প্রধান আর্থিক লেনদেন পরিষেবা সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দিতে সম্মত হয় জার্মানি ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। বিকল্প হিসেবে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের উপর রাশিয়ার নির্ভরতা বেড়েছে। গত অক্টোবরে দেশটি চীনা মুদ্রার জন্য চতুর্থ বৃহত্তম অফশোর ট্রেডিং সেন্টার হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শি জিনপিংয়ের এই সফরের মধ্যদিয়ে দেশ দুটির অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার পাশাপাশি, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও একটি স্পষ্ট বার্তা আসতে পারে।