মন খারাপ কাজ করতে চাইলে কী করবেন?

ফানাম নিউজ
  ০৯ মে ২০২৩, ০৪:১৭

অনেক সময় ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা জাগে খারাপ কাজ করার। কিন্তু ইসলাম মানুষের কাছে যা চায়, তা-ই সঠিক। সেটিকে মানুষের বিবেকও সঠিক বলে মেনে নেয়। কিন্তু তবুও, কখনো কখনো সঠিক কাজটা করতে ইচ্ছা করে না। মন খারাপ কিছু একটা করতে চায়, মন বন্য প্রাণীর মতো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এ সময়টিতে কী করবেন?

যখন প্রচণ্ড খারাপ লাগে কিংবা খারাপ কাজ করতে ইচ্ছা করে ঠিক তখনই জাহান্নামের আগুনের কথা মনে করা এবং আল্লাহকে প্রচণ্ড ভয় করা জরুরি। এ কথা সবাই জানে যে, যদি মানুষ নিজেদের নফসের কথা শুনে তাহলে ভয়ঙ্কর শাস্তির সম্মুখীন হবে। আর এই শাস্তি কোনো মানুষই চায় না।

মানুষের মনে খারাপ কাজ করার এই লড়াই প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। বিশেষ করে এ প্রবণতা তাদের মাঝে বেশি দেখা যায়, যারা ইসলামকে সত্য জানা সত্ত্বেও, জান্নাত-জাহান্নামকে সত্য মনে করা সত্ত্বেও বিভিন্ন খারাপ অভ্যাসে জড়িয়ে পড়েছে। এখন এর সমাধান কী?

প্রথমত নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস তুলে ধরা যেতে পার। যারে ফলে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। হাদিসটি হলো-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন আল্লাহ তাআলা জান্নাত এবং জাহান্নাম সৃষ্টি করেন, তখন তিনি জিবরিল আলাইহিস সালামকে এই বলে জান্নাতের দিকে পাঠান যে, জান্নাত এবং জান্নাতবাসীদের জন্য যা কিছু তাতে আমি প্রস্তুত করে রেখেছি, তা দেখে এসো। তিনি তা দেখে ফিরে এসে বললেন- আপনার পরাক্রমের শপথ! এই জান্নাতের কথা শুনতে পেলে কেউ তাতে প্রবেশ না করে ছাড়বে না। এরপর তাঁর আদেশে তা (জান্নাত) কষ্টকর ও অপছন্দনীয় বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টন করা হলো। তারপর বললেন, সেখানে যাও এবং তা ও তার অধিবাসীদের জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছি তা দেখে এসো। তিনি গিয়ে লক্ষ্য করলেন যে, তা কষ্টদায়ক, মসিবত ও অপছন্দনীয় বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টন করে রাখা হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার পরাক্রমের কসম! আমার আশংকা হচ্ছে যে, তাতে কেউ-ই প্রবেশ করবে না।

(পক্ষান্তরে)আল্লাহ তাআলা বললেন, যাও জাহান্নাম এবং জাহান্নামবাসীদের জন্য আমি তাতে যা কিছু তৈরি করে রেখেছি, তা দেখে এসো। জিবরিল আলাইহিস সালাম তার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, তার এক অংশ অপর অংশের উপর চড়াও হচ্ছে। তিনি ফিরে এসে বললেন, আপনার পরাক্রমের শপথ! আমার আশংকা যে, এতে কেউ প্রবেশ করবে না। এরপর আল্লাহর আদেশে তাকে (জাহান্নাম) মুগ্ধকর বস্তু দ্বারা পরিবষ্টন করে দেওয়া হলো। আল্লাহ বললেন, তুমি এখন গিয়ে তা দেখে এসো। তিনি গিয়ে দেখলেন যে, তাকে মুগ্ধকর বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টন করে রাখা হয়েছে। তিনি ফিরে এসে বললেন, আপনার পরাক্রমের শপথ! এখন আমার আশংকা হচ্ছে যে, এতে প্রবেশ করা থেকে কেউ নাজাত পাবে না।’

এ হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, নফস যদি খারাপ কিছু করতে চায়, এটা খুবই স্বাভাবিক। এখানেই মুমিন বান্দার পরীক্ষা। যখন আপনার মন আল্লাহর অবাধ্য হতে চায়, তখন আপনি কার কথা শুনেন? আল্লাহর কথা নাকি আপনার প্রবৃত্তির কথা?

হ্যাঁ, তখন আল্লাহর কথা শোনা জরুরি। যদিও তা শুনতে মন না চায়। শুধু আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে। তাঁর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। সেই মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছে এটাই চান। আর তা হলো— তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ।

মানুষকে অবশ্যই তাঁর হুকুম অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক তাঁর বিধান অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আল্লাহ জানেন মানুষ তার কামনা-বাসনার অনুবর্তী হতে চায়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন।

আবার যেই শয়তান সবসময় মানুষকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে যায়, সেই শয়তানও আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষের ভেতরের সকল কামনা আকাঙ্ক্ষা তাঁরই সৃষ্টি। এই সব কিছু সেই বড় পরিকল্পনার অংশ। আর তাহলো- মানুষকে পরীক্ষা করা। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা বলেন ঘোষণা করেছেন-

الَّذِیۡ خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَ الۡحَیٰوۃَ لِیَبۡلُوَکُمۡ اَیُّکُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا
‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- ‘আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি সর্বোত্তম?’ (সুরা মুলক: আয়াত ২)

মন খারাপ কাজ করতে চাইলে মানুষ কার কথা মতো কাজ করে?

যখন মানুষের মন খারাপ কিছু করতে চায়, তখন সে কার কথা অনুযায়ী কাজ করে? যখন শয়তান মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা দেয়, তখন মানুষ কার কথা অনুযায়ী কাজ করে? বান্দা কি আল্লাহর কথা শোনে নাকি নিজের মনের কথা শোনে?

এই সময়টিতে মানুষ যদি আল্লাহর আনুগত্য করে এবং বার বার আল্লাহর আনুগত্য করতে থাকে তাহলে একসময় ইসলাম পালন করা মানুষের জন্য সহজ হয়ে যায়। মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েও তায়েফের লোকজন জেনা-ব্যভিচার ছাড়তে চায়নি, সুদ ছাড়তে চায়নি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। তারা ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ইসলামের বিধিবিধান মানতে চায়নি। এ ব্যাপারে তায়েফের অধিবাসীদের একদল প্রতিনিধি মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এ নিয়ে কয়েকদিন যাবত আলোচনা চালিয়ে যায়।

দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ইসলাম তাদের অন্তরে প্রবেশ করে। ইসলামের বিধিবিধানের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়। তাই, মন না চাইলেও আল্লাহর আনুগত্য করা জরুরি। আল্লাহর বিধান মানা ছাড়া কোনো পথ নেই। কেননা মুমিন বান্দার জন্য জাহান্নাম কখনো কোনো পছন্দ হতে পারে না।

শয়তান হয়তো মানুষকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে বলতে পারে- ‘তুমি তোমার মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পারবে না।’ কিন্তু এটা সত্য নয়। কেননা মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন-
لَا یُکَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا ؕ لَهَا مَا کَسَبَتۡ وَ عَلَیۡهَا مَا اکۡتَسَبَتۡ
‘আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। সে যা অর্জন করে তা তার জন্যই এবং সে যা কামাই করে তা তার উপরই বর্তাবে।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৮৬)

মানুষের নফসের বিরুদ্ধে জেতার সামর্থ্য দিয়েই আল্লাহ তাআলা তাকে সুষ্টি করেছেন। সুতরাং আল্লাহ মানুষকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, মানুষ সেই কাজ করার সামর্থ্য রাখে।

মনে রাখতে হবে শয়তান মানুষের অন্তরে নেগেটিভ সব চিন্তা-ভাবনা ঢুকিয়ে তাকে হতাশ করে দিতে চায়। মানুষকে হতাশ করে দিলে তার কী লাভ? তার লাভ হলো- যদি মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে তাহলে আবার খারাপ অভ্যাসগুলোতে সহজেই জড়িয়ে পড়বে।

তাই মন খারাপ হলে-

মনকে ভালো করে তোলা। আলস্য ছেড়ে দ্রুত উঠে পড়া। নামাজ আদায় করা বাকি থাকলে নামাজ আদায় করে নেওয়া। খারাপ কোনো কাজ করতে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তা থামিয়ে দেওয়া। তাহলেই পরকাল নিয়ে মানুষের মাঝে ইতিবাচক আশা তৈরি হবে। আর যখনই মানুষ পরকাল নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠবে, তখনই মানুষের অন্তরে খারাপকে মোকাবেলা করার শক্তি তৈরি হবে, ভালো কাজ করার উৎসাহ বেড়ে যাবে।

শয়তান মানুষের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্তে আক্রমণ করে বসে। সেই দুর্বল মুহূর্তটি খুঁজে বের করা। সে সময়টি হতে পারে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর বা অন্য কোনো সময়। এই খারাপ মুহূর্তটি যখনই হোক; মন খারাপ হলে- সে সময় ভালো কিছু করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। বাইরে থেকে ঘুরে আসা। জোর করে কোনো ইসলঅমি আলোচনা শোনা। কোরআন তেলাওয়াত শোনা। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী পড়া। আল্লাহর কাছে সুন্দর সুন্দর দোয়া করতে থাকা। বেশি বেশি জিকির করা। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া। দোয়া পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া। এতে শয়তান পরাজিত হবে। আল্লাহর রহমতে জিতে যাবে মুমিন বান্দা।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে মন খারাপ হলে ভালো কাজের মধ্যে সময় ব্যয় করার তাওফিক দান করুন। নফসের সব খারাপ প্ররোচণায় নিজেকে আল্লাহমুখী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ধর্ম এর পাঠক প্রিয়