বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত

ফানাম নিউজ
  ১৬ মে ২০২৩, ০২:৩০

বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক রইছ আহমেদ মান্নাকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউনিয়া থানা পুলিশ। 

সোমবার আদালতের নির্দেশে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর পর মহানগরের কমিটি বিলুপ্ত করল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের জরুরি সভায় বরিশাল মহানগরের বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কাউনিয়া থানার ওসি আব্দুর রহমান মুকুল জানান, আট নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম, জাহিদ ভূঁইয়া ও মনা আহমেদকে রোববার রাত ৮টার দিকে কুপিয়ে জখম করা হয়। তাঁরা শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতরা জানিয়েছেন, নৌকার নির্বাচনী কর্মী হওয়ায় তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আহত মনা বাদী হযে ছাত্রলীগ নেতা মান্নাসহ গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

বরিশাল সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ৬ খলিফার অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা মান্না। আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিতব্য সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি মেয়র সাদিকের চাচা। মনোনয়ন বঞ্চিত মেয়র সাদিকসহ তাঁর অনুসারীরা খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচনী কার্যক্রমে এ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেননি।

গত ১০ বছর বরিশাল নগরীতে মান্না ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজিসহ বিরোধীয় জমি দখল ছিল তাঁর আয়ের প্রধান উৎস।

বরিশাল সিটি নির্বাচনে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর নগরীতে সাদিকের একক আধিপত্যের পতন হয়। তবে তাঁর অনুসারী অন্যরা ধীরে ধীরে চুপসে গেলেও মান্না ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। গত কয়েকদিনে নৌকার কর্মী-সমর্থকদের ওপর একাধিক হামলা হয় তাঁর নেতৃত্বে।

একাধিক দলীয় সূত্র জানায়, ১০ বছর আগে মান্না ছাত্রলীগের অখ্যাত কর্মী ছিলেন। মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানের মোটরসাইকেল চালক হিসেবেই তাঁকে চিনতেন সবাই। মায়ের ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে অসীম দেওয়ানের সঙ্গে ২০১৪ সালের দিকে মেয়র সাদিকের বিরোধ শুরু হয়। অসীমকে দমনে সাদিকের হাতিয়ার হয়ে ওঠেন মান্না। বাড়িতে একের পর এক হামলা-গুলিবর্ষণসহ নানামুখী প্রতিরোধের মুখে ওই বছরের শেষ দিকে অসীম বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় আশ্রয় নেন। জানা গেছে, এর পুরস্কার হিসেবে সাদিকের আরও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন মান্না।

এ ছাড়া বরিশাল আওয়ামী লীগে সাদিক আবদুল্লাহর পরিবার বিরোধীদের কোণঠাসা করতে প্রধান সেনাপতির ভূমিকায় ছিলেন মান্না। মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, এবার ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন (৪ জানুয়ারি) শহরের নুরিয়া স্কুলে সাদিকবিরোধীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সন্ধ্যার পর মান্না বিশাল মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে গুলিবর্ষণ ও বোমা মেরে অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেন। সাবেক এমপি জেবুন্নেছা আফরোজ তাঁর মালিকানাধীন প্লানেট ওয়ার্ল্ড শিশুপার্কে কর্মিসভা করার সময় মান্না সীমানাপ্রাচীরের বাইরে থেকে বোমা নিক্ষেপ করেন।

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান বলেন, মান্নার নেতৃত্বে কয়েকবার তাঁর বাসায় হামলা-ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। প্রাণভয়ে ২০১৪ সালের শেষের দিকে তিনি বরিশাল ছাড়েন। খোকন সেরনিয়াবাত মনোনয়ন পাওয়ার পর আবার বরিশালে ফিরেছেন।

এ ছাড়া ২০২১ সালের আগস্টে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা, একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিসিক শিল্পনগরীতে জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফরচুনে দফায় দফায় হামলা এবং এ ঘটনার জেরে কাউনিয়া থানা ঘেরাও ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন মান্না। এসব মামলায় আসামি করা হয় তাঁকে।

তবে এসব ঘটনার পুরস্কার হিসেবে দুই স্ত্রী ও তিন সন্তানের বাবা মান্নাকে গত বছরের জুলাইয়ে মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পদ দেওয়া হয়। তার আগেই ‘আহমেদ পরিবহন’ নামে তিনটি বাস ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে মেরিন একাডেমির পাশে ১০ শতক জমিতে বিশাল পাঁচতলা ভবনের মালিকসহ বিত্তশালীতে পরিণত হন। চলেন নিজের নোহা গাড়িতে। তিনি বরিশালে আইনের ছাত্র বলে জানা গেছে।

সাদিক আবদুল্লাহ ২০১৮ সালে সিটি মেয়র হওয়ার পর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান তখনকার পদহীন ছাত্রলীগ নেতা মান্না। টার্মিনালে চাঁদাবাজি ও অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের মেয়াদে তাঁর অনুসারী যুবদল নেতা মো. শাহিন সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে বাস টার্মিনালসংলগ্ন সড়ক ও জনপথের (সওজ) জমিতে দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। সেখানে রয়েছে ১২০০ স্কয়ার ফুটের ‘নিউ বাঙ্গালী’ নামের খাবার হোটেল। হোটেলের পেছনে সওজের জমি দখল করে দ্বিতল ভবনের নিচতলায় ১৩টি স্টল ও দোতলায় আবাসিক হোটেল করেছিলেন তখনকার পরিবহন শ্রমিক নেতা নুরে আলম। মান্না টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর সব দখল করে নেন। আবাসিক হোটেল বন্ধ করে সেখানে তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয় স্থাপন করেন। বাঙ্গালী হোটেল নিজেই পরিচালনা করছেন।

মান্নার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হলো বিরোধপূর্ণ জমি একপক্ষের কাছ থেকে অল্প মূল্যে বায়না করে দখল করা। নগরের কেএমসি হাসপাতালের পরিচালক এসএম কাওছার হোসেন জানান, কাউনিয়ায় মান্নার বাসার অদূরে ৩৯ শতক জমি নিয়ে স্থানীয় জাহাঙ্গীরদের সঙ্গে মামলা চলছিল তাঁর। নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে মান্না সেই জমির ৮ শতক জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ৫৬ লাখ টাকায় বায়না করেন। গত ১৬ ডিসেম্বর দলবল নিয়ে মান্না জমি দখলে নেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে মান্নাকে দেখে নীরবে চলে যায়। কাউনিয়া থানা পুলিশ তাঁর মামলাও গ্রহণ করেনি। নগরের আশপাশে ভাড়ায় গিয়ে জমি দখল করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইছ আহমেদ মান্না গ্রেপ্তারের পর সেলফি এবং থানার হাজতখানায় অবস্থানের ছবি ভাইরাল হওয়ায় কাউনিয়া থানার এসআই সাইদুল ইসলামকে ক্লোজ করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে তাঁকে ক্লোজ করার আদেশ দেয় মেট্রোপলিটন পুলিশ। মান্নাকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে নিয়ে এসআই সাইদুলের সেলফি এবং মান্না ও তাঁর ১০ সঙ্গীর থানা হাজতের মেঝেতে ঘুমানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।