রক্ত দেওয়া বাবা হারা ছেলেটি নিজেই ভেসে গেলেন রক্তে

ফানাম নিউজ
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৭:১৭

মাহমুদ হাবিব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে নয়টার পর থেকে শারীরিক বিচারে তিনি অতীত। ক্যাম্পাসের ভেতরে ট্রাকচাপায় চলে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। 

মাহমুদ হাবিবের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে দেখা যায় বন্ধু,সহপাঠী আর সতীর্থদের আর্তনাদ। ফেসবুকে মাহমুদের পুরো নাম মাহমুদ হাবিব হিমেল। বাবার বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি করতেন জনকল্যাণমূলক কাজ। ফেসবুকে তাঁর পরিচয়ে লেখা রয়েছে সহসভাপতি, বাঁধন, শহীদ শামসুজ্জোহা হল ইউনিট, রাবি জোন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক। বাঁধন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের অন্যতম একটি সংগঠন। 

ফেসবুকে বাল্যবন্ধু পরিচয় দেওয়া ফয়সাল মাহমুদ নামের একজনের স্ট্যাটাস থেকে জানা গেল মাহমুদ তাঁর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা প্রয়াত, মা শারীরিকভাবে অসুস্থ। ফয়সাল মাহমুদের স্ট্যাটাসটি এমন, ‘আমার ছোট বেলার বন্ধু। সে আমাকে এ বায় বলে ডাকত। যাচ্ছি তার সাথে শেষ বারের মতো দেখা করতে। আমি যখন প্রথম খবরটি শুনলাম মনে হচ্ছিল হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা সম্ভবত অন্য কোনো হিমেল হবে। কিন্তু না, আমার ধারণাটা ভুল ছিল। এটাই প্রমাণ হলো যে আমাদের বন্ধু আর নেই। আসলেই নাই। সে ছিল তার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। কোনো ভাই বোন ছিল না তার। ছোট বেলায় তার বাবা মারা যায়। হিমেলের আম্মুও শারীরিক ভাবে অসুস্থ অনেক আগে থেকেই। একমাত্র হিমেলকে নিয়েই তিনি বেঁচে আছেন বলা চলে। খবর টি শোনার পর আমার তখন হিমেলের আম্মুর কথা মনে পড়ল। সে যখন এই খবর টা পাবে তার কি অবস্থা হবে?? এইটা ভাবতেই ভয় লাগছে। যাই হোক ভালো থাকিস বন্ধু’।

মেসেঞ্জারে ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া গেল মাহমুদের বাড়ির ঠিকানা। তিনি জানালেন, মাহমুদের বাবার বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার উলিপুর গ্রামে। আর নানা বাড়ি নাটোরে। তাঁর অসুস্থ মা এখন নাটোরেই থাকেন।

মাহমুদের ফেসবুক ওয়াল ছেয়ে গেছে সতীর্থদের শেয়ার করা রক্তমাখা স্কেচ আর স্মৃতি কথায়। তাঁদেরই একজন মুশাররফ হোসাইন তাঁর দীর্ঘ স্ট্যাটাসের শেষে লিখেছেন, ‘ভাই আজ সত্যি সত্যিই নিজের সব রক্ত দিয়ে রাবি ক্যাম্পাস রঞ্জিত করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন ওপারে। এই রক্ত মাখা ক্যাম্পাসে আমি কি করে হাঁটবো!!’ মোমিনুর আকাশ নামের একজন তাঁর স্ট্যাটাসের একাংশে লিখেছেন, দুইটা ভালো মানুষের মৃত্যু দিবস একই দিনে হলো ‘১লা ফেব্রুয়ারি’,আর একটা ব্যাপার আছে সেটাও জেনে রাখ তোর মৃত্যু আজও আমি মানতে পারি নাহ আবার হিমেল ভাইও চলে গেল, ভালো মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে জানিস তো। মোমিনুর আকাশের স্মরণ করা দ্বিতীয় মানুষটি হলেন, আতিক-উল গণি দীপ্ত নামের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত আরেক শিক্ষার্থী।

সদ্য প্রয়াত মাহমুদের ফেসবুক ওয়ালে তিন মিনিটের একটি ভিডিও দেখা যায়। যেখানে বন্ধু-সহপাঠীরা নীল রঙের পলিথিনে ঢেকে মাহবুবের মরদেহ একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন। শিক্ষার্থীদের কান্নার রোলে সেই ভিডিও হজম করা দুষ্কর। এর মধ্যে ‘আমার বন্ধুরে ভালো ভাবে ধরেন...’ এ কান্নার আওয়াজ কোনো ভাবেই সহ্য করা যাচ্ছিল না।

মাহমুদের রক্তমাখা স্কেচ সংযুক্ত করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কনক পিকে লিখেছেন, ‘আহা! হিমেল। আমার ফেসবুক তালিকার সর্বশেষ বন্ধু। আতঙ্কে আমার ছেলে কণাদের ঘুম আসছে না। ওর মাকে রাস্তায় হাঁটতে দেবে না আর। হিমেলের মায়ের কেমন লাগছে?’

ক্যাম্পাসের নির্মাণাধীন একটি একাডেমিক ভবনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাক চাপায় নিহত হন মাহমুদ। তাঁর মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন। সে বিষয়টি তুলে ধরে বুলবুল নামের এক শিক্ষার্থী লিখেন, ‘হিমেলের মা যদি জিজ্ঞেস করেন- আমার হিমেল বাবার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে কবরে শুইয়ে দিই, কেউ কি মাথাটা এনে দিতে পারবেন??’

আজ বুধবার সকালে জানাজার জন্য মাহমুদের মরদেহ মর্গ থেকে ক্যাম্পাসে আনা হবে। এমনটাই জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহউপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া। আর শিক্ষার্থীরা চাইছেন তাঁদের দাবি করা ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানাজার আগেই ঘোষণা আসুক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

সূত্র: প্রথম আলো