গরুর মাংস

হালিমা রিমা
  ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০৩:৫৫

মা মাগো ঘুমাইছো তুমি?
রতনের ডাকে সুফিয়ার ঘুম ভাংগে। আধো ঘুম জড়ানো গলায় বলেন,
‘এত রাতে কেন ডাকছ? ঘুমাও নাই।’
রতন মার বুকের আরও কাছ ঘেঁষে শোয়। তারপর বলে,
‘মা,ছোট গরুর মাংস কি সস্তা?’
সুফিয়া বলে, ‘নারে ব্যাটা। যত ছোট দাম তত বেশী।’
এবার রতন দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্য পাশ ফিরে শোয়।

রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রতন স্বপ্ন দেখে মা বেশী করে আলু কেটে দিয়ে ঝাল করে গরুর মাংস রান্না করে তাকে খেতে দিয়েছে। কি স্বাদ আর গন্ধ। তার জিভ দিয়ে যেন জল পড়ছে। এদিকে তার মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া লালায় মাথার বালিশ ভিজে যায়।

সকালে মায়ের ডাকে তার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়। মা তাকে দুইটা রুটি আর একটু আলু ভাজি দিয়ে দেয়। এই খেয়ে সে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর তার মা এলে রান্না করে। মা বেটায় মিলে গল্প করতে করতে ভাত খায়। বেশীরভাগ দিনই মা আলু ভর্তা আর ডাল রান্না করে। মাঝে মাঝে মা তার পছন্দের বেগুন বা পটল ভাজি করে। মায়ের হাতের রান্নার যে কি সোয়াদ। পেটভরে ভাত খেতে পেলেই তারা খুশী।

স্কুল থেকে ফিরে সে বস্তিতে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলে। ছোট্ট জায়গাতেই তারা লাটিম ঘুরায়। তার সবচাইতে প্রিয় খেলা লুকোচুরি। বস্তিতে লুকানোর অনেক জায়গা। অন্য বাচ্চারা স্কুল থেকে এসে ফুল বিক্রি করে বা চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটে। তার মায়ের বারন বাইরে যাওয়া বা এধরণের কাজ করা। সে তার মাকে খুব ভালোবাসে।

মা বলেছে,
‘বাসায় বসে পড়াশোনা করবি বাপধন। তুই একদিন পড়া শেষ করে বড় চাকরি করবি। আমরা একটা সুন্দর বাসায় মায়ে পুতে থাকব।’
রতন দেখেছে তার মা যখন এসব কথা বলে তখন তার চোখ কেমন চকচক করে।তাই সে ঠিক করেছে সে একদিন মায়ের সব দুঃখ দূর করবে।

রতন একা যখন থাকে অনেক কাজ করে। সে ঘর ঝাড়ু দেয়৷ প্লেট, গ্লাস ধুয়ে রাখে। মা যে চাল কিনে আনে তাতে অনেক ময়লা আর পাথর। সে যত্ন করে চাল পরিষ্কার করে বেছে রাখে। প্রথম মা অনেক রাগ করত বলত, ‘বাপধন পড়া রাইখা তোমার এইসব করার দরকার নাই।’

সে বলেছে, ‘মা আমার স্কুলের পরে অনেক সময়। আমার চাল বাছতে খুব মজা লাগে। চালে কত রকমের কাকড় আর পাথর থাকে এই ধর সাদা, হলুদ,লাল,কাল। মা আমি এই পাথর জমাইতেছি।’
আচ্ছা মা গফুর চাচা এমন পাথর দেয়া চাল দেয় কেন? এক কেজি চালে মা দ্যাহ কত্ত পাথর। সুফিয়া দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘এই চাউল কিনতে বাপধন ষাট টাকা লাগে।’

রতন দেখেছে তাদের বস্তিতে তার বয়সী বাচ্চারা সিগারেট ফুঁকে কেউ কেউ আবার টাকার বাজি ধরে জুয়া খেলে। তাকে বস্তির অন্য বাচ্চারা সেখানে নিয়ে যেতে চায়। তারা বলে,
– ‘রতন তোর মা থাকে অফিসে সে টের ও পাইব না। চল কিযে মজা ! গেলে বুঝবি।’
কিন্তু সে কোন দিন যায় নি।
তার সব সময়ে তার মায়ের মুখটা চোখে ভাসে। তার মায়ের যে সে ছাড়া আর কেউ নাই।

আজ মা আসার পর সে আবার বলে,
মা দুই টুকরা মাংস কিনতেও কি অনেক টাকা? সুফিয়া বেশ বুঝতে পারেন তার বাপধনের আবদার। তিনি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
‘মাংস কিনতে সাতশত টাকা। আধা কেজিও অনেক টাকা বাপধন।কুরবানির ঈদে মাংস দিয়া ভাত খাইও।’ এটা বলে তিনি তার ছেলের কপালে চুমু দেন।

রতন আজ স্কুল থেকে আসার পথে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি রতনের এত ভাল লাগে। সে মনের আনন্দে ভিজতে থাকে। কতক্ষণ ভিজেছিল ঠিক নেই। সে যখন ঘরে ফিরে তখন তার খুব শীত করছিল।তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় পালটে সে শুকনো জামা গায়ে দেয়। এরপর কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে খেয়াল নাই। অনেক রাতে মায়ের ঠান্ডা হাতের স্পর্শে তার ঘুম ভেঙে যায়। মা তখন তার মাথায় পানি পট্টি দেয়। তিনদিন পর রতনের জ্বর কমে যায়। এই তিনদিনে তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গিয়েছে ।তার খেতে একদম ভাল লাগে না।

তার সবসময় গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে মন চায়। আজ সে দেখেছে পাশের বাড়ির জামালদের বাড়িতে মাংস রান্না হচ্ছে। মাংসের গন্ধে তার ক্ষুধা বেড়ে যায়। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রাণভরে খাবারের গন্ধ নিচ্ছিল। পিছনে তার মা এসে কখন দাঁড়িয়েছে সে টের পায় নাই। হঠাৎ মায়ের ডাকে সে লজ্জা পায়।
মা বলে, ‘বাপধন এইখানে দাঁড়াইয়া কি কর?’
– মাংসের কি সুন্দর গন্ধ তাই না মা।

এইবার তার মায়ের দুচোখ ভরে যায় পানিতে। তিনি কিছু না বলে চোখের পানি আড়াল করে সেখান থেকে সরে আসেন। তার মাথায় তখন ঘুরতে থাকে আধা কেজি গরুর মাংস; আধা কেজি গরুর মাংস । তার যেভাবেই হোক কিনতে হবে।

আজ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে শিফট ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি দেয়।
সুফিয়ার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ভুঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে পান খাওয়া বিচ্ছিরি লাল কাল দাঁত বের করে বলে ,
–’কি গো সুফিয়া রানি আইজ বড় খোশ মেজাজে আছ। অন্যদিন তো আমারে দেখলেই খ্যাঁক করে উঠ।’
সুফিয়া এবার চোখ টিপ দিয়ে ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি দিয়ে বলে, ‘আপনে না কি জানি কইবেন বইলা ডিউটির পর থাকতে বলছিলেন সেইদিন?’
‘–আইজ থাকলে চলব?’
–্ম্যানেজার এবার পিচাশের মত তার সব দাঁত বের করে আর জিহ্বা দিয়ে তার কালো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, ‘কাজ শেষে দেহা কইরো।’
–সুফিয়া এবার বলে, ‘আমারে বিনিময়ে কি দিবেন?’
–ম্যানেজার কুটিল হাসি দিয়ে বলে বেশী ডিউটি পাবি সামনের মাসে।
–সুফিয়া বলে না আধা কেজি গরুর মাংস কিনা দিবেন।
–ম্যানেজার কপাল কুঁচকে পরক্ষনেই গা দুলিয়ে হাসতে থাকে।
–’ময়নাপাখির বুঝি মাংস খাইতে মন চাইছে। যা পাবি।’

সুফিয়া গরুর মাংস নিয়ে বাসায় ফিরেছে। সে অনেক যত্ন করে বেশী করে আলু কেটে দিয়ে মাংসের ঝোল রান্না করেছে। রতনের মনে আজ অনেক আনন্দ। সে ভাতের থালা নিয়ে মায়ের সামনে বসে আছে অথচ মাংস তখনও চুলায় সেদ্ধ হচ্ছে।
– রতন বলে,মা মাংসের কি সুন্দর সুবাস তাই না!
সুফিয়া আঁচলে চোখ মুছে বলে, ‘হ বাপধন পেটের ক্ষিধা আর খাওনের চাইতে আর বড় কিছু নাই। চাইরটা খাওনের জন্য অনেক কিছু করা লাগে রে বাপধন অনেক কিছু—-------------।’

সাহিত্য এর পাঠক প্রিয়