আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে, এমন নির্মম ছবি দেখিনি: হাইকোর্ট

ফানাম নিউজ
  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২৩:৩৯

রাজশাহীর বাগমারায় ৫০টি তালগাছে কীটনাশক প্রয়োগ করে মেরে ফেলার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। কীটনাশক দেওয়া ৫০টি তালগাছের একগুচ্ছ ছবি দেখে আদালত বলেন, ‘আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। একটা পশুরও তো মায়া থাকে! এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।’

রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) এ সংক্রান্ত এক শুনানিকালে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

গত ১ ফেব্রুয়ারির তলবের ধারাবাহিকতায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহরিয়ার আলম আজ হাইকোর্টে হাজির হয়ে তালগাছের বিষয়ে তার ব্যাখ্যা আদালতে দাখিল করেন। সেখানে তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে আদালত আজকের শুনানির শুরু থেকে বিকেলে কোর্ট নেমে যাওয়া পর্যন্ত শাহরিয়ার আলমকে দাঁড় করিয়ে রাখেন।

শুনানির একপর্যায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘আইন-আদালত দিয়ে দেশের কোটি-কোটি মানুষকে ভালো করা সম্ভব না। যদি না আমরা নিজেরাই মানবিক ও সচেতন না হই।’

এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘একটা পশুরও তো মায়া থাকে! বিষ দেওয়া তালগাছগুলোর ছবি দেখে আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। এটাকে হালকা ভাবে দেখার সুযোগ নেই। সেই লোককে হাজার সালাম জানাচ্ছি, যিনি এই গাছগুলো লাগিয়েছেন।’

এছাড়াও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে তালগাছগুলোর করুণ চিত্র দেখে হাইকোর্ট বলেন, ‘আপনারা হয়তো মনে করবেন যে তালগাছের মতো ছোট্ট একটা বিষয়ও হাইকোর্ট দেখে? হ্যাঁ, আমাদের দেখতে হয়। কারণ, সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় জাগ্রত বিবেক। আমরা তালগাছগুলোতে বিষ দেওয়ার সংবাদ দেখে আহত হয়েছি। একটা গাছ বড় হতে ১২-১৪ বছর সময় লাগলো। আর সেই গাছগুলোর ডাল কেটে বিষ দিয়ে দেওয়া হলো!’

তালগাছ সৌন্দর্যময় ও সম্পদ উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, ‘আমাদের সমাজে বসবাসকারী কিছু পশু সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থে গাছগুলো নষ্ট করছে।’

‘দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য রাষ্ট্র একটি বাড়ির মতো, যা সাজানো হচ্ছে আমাদের কাজ। প্রতিটি মানুষই রাষ্ট্রের একটি অংশ। নিজেকে যদি এভাবে প্রস্তুত করা যায়, তাহলে দেশটা অনেক সুন্দর হবে। আইন দিয়ে সবকিছু ঠিক করা যাবে না, যদি না নিজেরাই সচেতন ও সতর্ক হই।’

আদালতে আজ শাহরিয়ার আলমের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. জাহিদুল হক জাহিদ। প্রথম আলোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী।

‘৫০ তালগাছে কীটনাশক’ শিরোনামে গত ৩১ জানুয়ারি একটি জাতীয় পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এটি নজরে আসার পর ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। এ অনুসারে আজ আদালতে হাজির হন শাহরিয়ার আলম। তার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. জাহেদুল হক। আদালতের আদেশ অনুসারে সরেজমিনে উল্লেখিত গাছগুলোর ছবিসহ তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আদালতে উপস্থিত হন বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক। আদালত কৃষি কর্মকর্তার বক্তব্য শোনেন। আদালতের মৌখিক আদেশে কয়েক ঘণ্টা আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাহরিয়ার আলম।

হলফনামা আকারে কৃষি কর্মকর্তার প্রতিবেদন ও ছবি আদালতে দাখিল করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস-আল-হারুনী। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজা বেগম ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনিচ উল মাওয়া। প্রকাশিত খবরের সত্যতা জানাতে প্রথম আলোর পক্ষে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার সময়ের আরজি জানান।

ঘটনায় সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে শাহরিয়ারের পক্ষ থেকে শুনানিতে দাবি করা হয়, বিদ্বেষপ্রসূত ঘটনাটি প্রচারিত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষি কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভাষ্য, আমগাছ বাড়াতে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য তালগাছগুলো ক্ষত সৃষ্টি করে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মারার অপচেষ্টা হয়েছে। তালগাছ রক্ষার্থে তার কোনো উদ্যোগ ও আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। তালগাছগুলোর ক্ষতি করার পেছনে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে শাহরিয়ার জড়িত মর্মে কৃষি কর্মকর্তা মনে করেন।

সকালে ওই তালগাছগুলোর ছবি আদালতে দাখিল করা হয়। আদালতে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ও আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হককে ছবিগুলো দেখতে বলেন হাইকোর্ট। এ সময় আদালত বলেন, ‘একজন বৃদ্ধ লোক প্রকৃতি ও দেশকে ভালোবেসে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। এই জাতির যেমন সুসন্তান ও বীরশ্রেষ্ঠ আছে। আবার কুলাঙ্গারও আছে। বাকল কেটে বিষ প্রয়োগ করে, পত্রিকায় দেখেছি। সুপ্রিম কোর্টকে জাগ্রত বিবেক বলা হয়। যে কারণে রাত আড়াইটায়ও আদালত আদেশ দেন।’

আদালত আরও বলেন, ‘মনে করছেন— ছোট্ট একটি তালগাছ, এটিও কোর্ট দেখে। প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প যে তালগাছ লাগানো। একজন বৃদ্ধ মানুষ, বাবার বয়সী মানুষ, উনি আগামী দিনের জন্য সন্তানদের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে তালগাছ লাগিয়েছেন। অথচ কুসন্তান বিষপ্রয়োগ করেছে— এরা দেশকে কী দিলো?’

মধ্যাহ্ন বিরতি থেকে এসে শুনানিতে আদালত বলেন, ‘একটি পশুরও মায়া থাকে। পশুরও একটা অনুভূতি থাকে। একটি গাছ হতে ১২ বছর সময় লাগে। ১২ বছর কে ফিরিয়ে দেবে? গাছের জীবন আছে। ইচ্ছা করলে একটি গাছ সৃষ্টি করতে পারবে না। এই পশুদের চিহ্নিত করাই হচ্ছে কাজ। সে পশু যে–ই হোক না কেন, যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন? এটি হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই। গাছের যে ছবি দাখিল করা হয়েছে, আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। এমন হৃদয়বিদারক ও নির্মম ছবি দেখিনি।’

ওই ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বরাবর গত ৩০ জানুয়ারি চিঠি পাঠান বলে শুনানিতে উঠে আসে।

শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ওই জিডির ভিত্তিতে কী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বাগমারা থানার ওসিকে ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হয়ে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম আলোর বাগমারা প্রতিনিধিকে সেদিন আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। কথোপকথনের রেকর্ডসহ তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। সেদিন প্রথম আলোকে ওই প্রতিবেদনের সত্যতাও জানিয়ে হলফনামা দিতে বলা হয়েছে। শাহরিয়ার আলমকেও ওই দিন আদালতে হাজির হতে বলেছেন হাইকোর্ট। সেদিন পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য দিন রেখেছেন আদালত।