কারখানার পরিধি বাড়লেও শ্রমিকের ‘উন্নতি’ নেই

ফানাম নিউজ
  ০২ মে ২০২৪, ১৩:১৫

সংসারের অভাব ঘোচাতে রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন আবিদা। এরপর মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় নেন কাজ। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যভুক্ত কারখানাটিতে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। এখন ১৬ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। খাবার-পোশাক আর বাসাভাড়ায় চলে যায় প্রায় ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা গ্রামে মায়ের জন্য পাঠাতে হয় তাকে।

মহান মে দিবস নিয়ে আবিদার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, অভাবের সংসারের জন্ম। নিজের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই আমার। বাড়িতে বৃদ্ধ মায়ের জন্য কষ্ট হয়। আমার সব কিছুই তিনি (মা)। এখন বেতন কিছুটা বেড়েছে, যা খুবই সামান্য। এর সঙ্গে ওভারটাইম করে যা পাই তা দিয়ে সংসারের খরচ চলে না। কারণ বেতন যা বেড়েছে, খরচ তার কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে।

এতদিনের চাকরিতে সঞ্চয় কত করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুচকি হেসে আবিদা বলেন, সঞ্চয় হলে তো বিয়েটাই করে ফেলতাম। এখনো কোনো সঞ্চয় করতে পারিনি। সঞ্চয় কীভাবে হবে যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। মায়ের শুধু খাবারের ব্যবস্থা করলে তো হবে না, ওষুধও লাগে।

শুধু আবিদা নন, তার মতো শত শত তরুণ-তরুণীর জীবন এভাবে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা। অভাবের সংসারে দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিজের প্রয়োজন ভুলে সংসারের ঘানি টানছেন।

কথা হয় আরেক পোশাকশ্রমিক বকুলনেছার সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় ৮ বছর আগে ভোলা থেকে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় এসেছি। গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় থাকি। সেখানেই একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছি। সাত বছর কাজ শেষে এক সহকর্মীকে বিয়েও করেছি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে যা বেতন পাই, তা দিয়েই চলে সংসার। নিজেদের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই।

বর্তমানে আমি সন্তানসম্ভবা। তাই দুই মাস ধরে অনেক কষ্ট করে কয়েক হাজার টাকা জমিয়েছি। শারীরিক অসুস্থতাও বেড়েছে। এ কয়দিনে যা জমিয়ে ছিলাম চিকিৎসকের পরামর্শ ও ওষুধ কেনায় সব শেষ। গরিবের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়।

তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে দীর্ঘসময় কাজ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাকপেইনসহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে। সন্তানসম্ভবা হওয়ায় শরীর খুবই দুর্বল লাগে। মালিক যদি ছুটিসহ কিছু টাকা দেন তাহলে হয়তো ভালোভাবেই সন্তানের মুখটা দেখতে পারবো, তা নাহলে কি হবে জানি না।

পোশাকশ্রমিক হোসনেআরা বেগম কাজ করেন মালিবাগ এলাকায় একটি কারখানায়। রপ্তানিমুখী অন্য বড় কারখানার কাজ নেয় তাদের কারখানাটি। সেখান থেকে টাকা আসার ওপরই বেতন-বোনাস নির্ভর করে হোসনেআরার।

হোসনেআরা বেগম বলেন, ঈদের আগে শুধু বোনাস পেয়েছি। মার্চ মাসের বেতন এখনো অর্ধেক বাকি, যা মালিকদের ওপরে নির্ভর করছে। অর্ধেক বেতনের টাকায় বাসাভাড়া আর মেয়ের স্কুলের বেতন দিয়েছি। সংসার চালাচ্ছি দোকান থেকে বাকি এনে। বেতন হলে পরিশোধ করবো।

যদিও সবুজ কারখানার শ্রমিকদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ায় পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন তারা। তেমন সঞ্চয় না হলেও অন্য শ্রমিকের থেকে তুলনামূলক ভালো আছেন তারা। তবে কর্মকর্তা বা নির্বাহীরা ভালো আছেন, সঞ্চয়ও রয়েছে তাদের।

রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এ খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ শ্রমিক। কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। স্বাস্থ্যগত নানা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও শোভন মজুরি পান না তারা। পোশাকশ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় এমনটাই উঠে এসেছে।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, পোশাকশিল্পে বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে কারখানার পরিধি বাড়লেও শ্রমিকের উন্নতি নেই। দেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ট্র্যা জেডি ছিল রানা প্লাজা। এ দুর্ঘটনাকে সামনে রেখেই কারখানাগুলোয় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা হয়েছে। মালিকরা কারখানা উন্নত করেছেন, নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছেন। সবুজ কারখানার সংখ্যা বেড়ে দুই শতাধিক ছাড়িয়েছে, কিন্তু শ্রমিকের উন্নতি হয়নি। ফলে শ্রমিকের সংখ্যাও কমেছে।

২৩ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে শ্রমিক নেতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর নানা চাপের কারণে দেশের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। শহীদ শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে শিল্পে ইতিবাচক দিক ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সেই রানা প্লাজার ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিকদের পরিবার তাদের প্রাপ্যতা আজও বুঝে পাননি।

তিনি বলেন, অ্যাকর্ড-এলায়েন্সের কারণে বিজিএমইএ-বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানায় শিশুশ্রম নেই। তবে, এর বাইরে যেসব কারখানা রয়েছে সেগুলোয় শিশুশ্রমের অভাব নেই। এর দায়ভার কেউ নিতে চায় না। রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকরা দীর্ঘ ১১ বছর হুইলচেয়ারে, তাদের দীর্ঘশ্বাস শেষ হয়নি। তাদের দীর্ঘশ্বাস বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।

এ বিষয়ে কথা হলে বাংলাদেশ লেবার কংগ্রেসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খাদিজা আক্তার বলেন, আমাদের এখন পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিক কমে গেছে, তাদের সুযোগও কমে গেছে। এ বিষয়টা এখন দেখার সময় এসেছে। কিছু দিন আগে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আন্দোলন হলো সেখানে চারজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। বিনিময়ে বেতন হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১১ বছর হলো অথচ এখনো অনেকে সুস্থ হয়ে ওঠেনি, তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি। নিহত অনেকের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। আমরা চাই আহত শ্রমিকদের রেশনিং ব্যবস্থা যেন চালু করা হয়, এতে অন্তত কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।

শ্রমিক নেতা আব্দুল হাই বলেন, দেশের মধ্যে সবুজ কারখানা ২১৫টি। এর মানে মালিক পক্ষের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকের উন্নয়ন কোথায়, হয়নি। তীব্র গরমের কারণে সরকার সতর্কবার্তা হিসেবে হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। অথচ গত সপ্তাহেও ফতুল্লায় আমার শ্রমিক ভাই-বোনদের গরম উপেক্ষা করে বেতনের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে কি দেখা গেলো বেতনের পরিবর্তে তাদের ওপরে নেমে আসে পুলিশের লাঠির আঘাত, এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়।