বিশ্বে বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা

ফানাম নিউজ
  ২২ জানুয়ারি ২০২২, ০১:২৬

নির্মল চন্দ্র দাস সর্দিতে ভুগছেন প্রায় তিন মাস ধরে। রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফিট রাস্তার কাঞ্চন ব্রিজ অংশে যানবাহনের চাকা মেরামত করেন তিনি। ১২ কিলোমিটারের মতো দীর্ঘ নির্মাণাধীন সড়কটি যেন ধুলার রাজ্য।

চলতি মাসের মাঝামাঝি কোনো এক বিকেলে ধুলায় মাখামাখি অবস্থায় নির্মলের সঙ্গে দেখা হয়। কথার ফাঁকে তিনি বলেন, ‘এই ধুলাবালুর মধ্যে কাজকর্ম কইরা ঠান্ডা-সর্দি লাইগ্যা গ্যাছেগা। গরিব মানুষ; চলনতো লাগব পয়-পুলাপাইন লইয়া। এই কারণে ধুলাবালুর মধ্যেই থাহি। ’

নির্মলের মতো অনেক রাজধানীবাসীরই এখন ধুলায় মাখামাখি অবস্থা। ঢাকার বায়ুদূষণে ধুলার অবদান প্রায় ৭৭ শতাংশ বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ২০০৩ সালে এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। সম্প্রতি তিনি বলেন, বর্তমানে বায়ুদূষণে ধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আগে এত মেগা প্রজেক্ট (বৃহৎ প্রকল্প) ও গাড়ি ছিল না। পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে। ’

এদিকে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বায়ুদূষণে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। রাত ১০টা ৭ মিনিটেও ঢাকার অবস্থান একই ছিল। তবে সারা দিন এ অবস্থানে কিছুটা হেরফের হয়। বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘আইকিউ এয়ার’ থেকে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ধুলা এমনিতে বেশি। এরপর কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে নতুন নতুন নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প, পূর্বাচল সিটি ও বছিলার মতো কিছু অঞ্চল এবং অজস্র ছোট আবাসন প্রকল্প এর মধ্যে রয়েছে। যোগ হয়েছে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের মতো খানাখন্দে ভরা কিছু রাস্তা। এসব স্থান ছাড়াও রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ আরও কিছু এলাকায় ধুলার আধিক্য দেখা যায়।

এই অবস্থার মধ্যেও গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া—কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।

স্বাভাবিকের ১০ গুণ ধুলাও পাওয়া গেছে

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুসারে, এক বছরে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২. ৫ (২. ৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট ব্যাসের বস্তুকণা) ১৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত অনুমোদিত। কিন্তু শীতে ঢাকার কিছু অঞ্চলে বাতাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ ধুলাও পাওয়া গেছে।

ঢাকার ১০টি অঞ্চলে কোন ঋতুতে ধুলাদূষণ কেমন, তা ১০ মাস ধরে পরীক্ষা করছে স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। আবহাওয়াবিদদের কাছে ঋতু মূলত চারটি, প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা, বর্ষ—পরবর্তী ও শীত (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি)।

ক্যাপসের উপাত্ত অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ধুলাদূষণ হয়েছে শীতে। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ ধুলাদূষণ নিয়ে সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকা। সর্বনিম্ন দূষণ ছিল তেজগাঁও ও আহসান মঞ্জিল এলাকায়, সেটিও স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। এ ছাড়া প্রাক্-বর্ষা ঋতুতে সবচেয়ে দূষিত এলাকা ছিল শাহবাগ, স্বাভাবিকের ৭ গুণ। বর্ষায় সবচেয়ে দূষিত ছিল মিরপুর ও গুলশান এলাকা; স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ গুণ। বর্ষা-পরবর্তী ঋতুতে সর্বোচ্চ ধুলাদূষণ ছিল তেজগাঁও এলাকায়; স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ গুণ।

ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ধুলাদূষণ পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, ধুলা স্থানীয় উৎসে তৈরি, অন্য কোনো প্রান্ত থেকে আসছে না। যখন যে এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ হয়েছে, সেখানে ধুলাদূষণ বেশি হয়েছে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ধুলার ফাইন পার্টিক্যাল শরীরের ফুসফুস, কিডনির ক্ষতি করে। ধুলার সিলিকন শিশুদের নরম ফুসফুস শক্ত করে দেয়। ব্লাড ক্যানসারেও ভূমিকা রাখে।

সরেজমিন

মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন রাস্তা ও পূর্বাচলের ৩০০ ফিট রাস্তা জানুয়ারির মাঝামাঝি ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি। ৩০০ ফিটের রাস্তা দিয়ে দিনে কয়েক হাজার গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করে ও বের হয়। এ সময় ধুলার জন্য তাকাতে কষ্ট হয়। দেখা যায়, নির্মাণাধীন সড়কটির কিনারা ঘেঁষে ধুলা জমা হয়ে আছে। সড়কের পাশে কিছু দূর পরপর মাটির স্তূপ। রাস্তায় বিটুমিনের ওপর বালু ব্যবহার করা হয়েছে।

এ পথে মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন পূর্বাচলের ২১ নম্বর সেক্টরের আরমান মিয়া।

তিনি বলেন, ‘ধুলার জন্য এক জামা দ্বিতীয় দিন পরা যায় না। মোটরসাইকেল এক থেকে দুই দিন পরপর ধুইতে হয়। ’

মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ মোড় থেকে গাবতলী মোড় পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, রাস্তা কিছুক্ষণ পরপর ভাঙা। সারাক্ষণই ধুলা উড়ছে। এ সড়কের বিভিন্ন দোকানে পণ্যের জোগান দেন আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই রুটে মাল দিতে এলে সব সময়ই মাস্ক পরতে হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে ধুলায়।

দুই সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানো উল্টো কমেছে

রাজধানীর ধুলাদূষণ রোধে গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি তিন দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে ফায়ার সার্ভিস ও নগরীর ভেতরের রাস্তা-গাছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে পানি ছিটাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। আর পানির ঘাটতি হলে তা সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয় ঢাকা ওয়াসাকে। এরপরও ঠিকমতো পানি ছিটানো হচ্ছে না।

আগে মিরপুরের কিছু এলাকা এবং উত্তরা, গুলশানসহ কিছু এলাকায় পানি ছিটানো হতো বলে দাবি উত্তর সিটির। সম্প্রতি কেন কমেছে—এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তর সিটির মেকানিক্যাল বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পানির গাড়িগুলো ভারী যান হলেও চালাচ্ছিলেন মাঝারি গাড়ির লাইসেন্সধারীরা। নভেম্বরে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গাড়িগুলো রাস্তায় বের হচ্ছে না। চালকদের লাইসেন্স এখনো নবায়ন না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির শুধু ধানমন্ডি ৩২ এলাকায় একটি গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, দক্ষিণ সিটির পানি ছিটানোর গাড়ি আছে ৮টি। আগে বেশ কয়েকটি স্থানে ধুলার জন্য পানি দেওয়া হতো। এখন ওয়াসা থেকে পানি কিনতে হয়, যা ব্যয়বহুল। তাই পানি ছিটানো হচ্ছে না।

ওয়াসার একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘খাওয়ার পানি ব্যয়বহুল; প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। বিনা মূল্যে দেওয়া সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন চাইলে নদীর পানিও তো ব্যবহার করতে পারে। ’

অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, আদালতের নির্দেশনায় বিভিন্ন স্টেশনের কাছের প্রবেশপথগুলোতে প্রায়ই পানি ছিটানো হয়। তবে সব সময় গাড়ি নিয়োজিত রাখা সম্ভব হয় না। অগ্নিকাণ্ডের জন্য ১২টি গাড়ি সব সময় প্রস্তুত রাখা হয়। অন্য কাজে নিয়োজিত রাখলে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু ও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

দূষণ রোধে গত বছর ‘বায়ুদূষণ রোধ নির্দেশিকা’ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘ধুলা নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ভালো অবস্থায় যেতে পারিনি, এটা ঠিক। কিন্তু উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছি।’

বড় দায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) মতে, একটি আদর্শ নগরে ভবন ও সড়কে অবকাঠামো (৬০ ভাগ), সবুজ (২৫ ভাগ) ও পানি (১৫ ভাগ) থাকবে। এ ছাড়া শহরকে বর্ধিত না করে নতুন শহর গড়ে তুলতে হয়। দুই অংশের মাঝে বাফার এরিয়া (আঞ্চলিক বন, কৃষিজমি ও বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল) থাকবে।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের ক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ স্থাপনা ধারণ করে আছে। এরপরও শিল্পায়ন, কংক্রিটের ভবন, আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। বাফার এলাকাগুলো মাটি ও বালু দিয়ে ভরাট করে নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ফলে দূষণ রোধের এলাকাগুলো উল্টো দূষণ বাড়াচ্ছে। শুধু পানি ছিটিয়ে উষ্ণ আবহাওয়ায় ধুলা বেশিক্ষণ ভিজিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

সূত্র: প্রথম আলো